(প্রথম আলো ৪/২/২০১১ এর অন্য আলো হতে সংগ্রিহীত)
ইংরেজ শাসনের ২০০ বছরে অবিভক্ত ভারতে সংঘটিত হয় অজস্র বিপ্লব। যার বেশীরভাগ বঙ্গদেশে এবং কৃষক কেন্দ্রিক। কৃষক বিপ্লবের দীর্ঘ ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতিভূ হলো রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩), যার নায়ক কৃষক নূরুলউদ্দিন। মহান একুশের এই সংগ্রামী মাসে স্মরণ করছি রংপুর বিদ্রোহের প্রবাদপুরুষ নূরুলউদ্দিনকে, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যিনি সমকালে হয়ে উঠেছিলেন নবাব—মাটির নবাব। লিখেছেন কাজল রশীদ
ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা উপনিবেশিক শাসনের শুরুটা হয় পলাশির যুদ্ধে (১৭৫৭) ইংরেজ শক্তির জয় ও ভারতের ভাগ্য বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে।
কার্ল মার্কসের ফিউচার রেজাল্ট অব ব্রিটিশ রেভ্যলুশন ইন্ডিয়ায় উল্লিখিত হয়েছে, ‘মোগল সম্রাটের সামন্ত প্রতিনিধিরাই মোগল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতা চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া ফেলে। সেই প্রতিনিধিদের ক্ষমতা চূর্ণ হয় মারাঠাদের হাতে, আর মারাঠা-শক্তি চূর্ণ হয় আফগানদের দ্বারা। এইভাবে সকলেই যখন সকলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যস্ত, তখন ব্রিটিশশক্তি দ্রুত রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করিয়া সকলকেই পরাভূত করিতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষ এমন একটা দেশ, যাহা কেবল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যেই বিভক্ত নয়, এদেশটা বিভক্ত গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, জাতিতে জাতিতে। ইহা এমন একটা সমাজ, যাহার কাঠামোটা যে ভারসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, সেই ভারসাম্যের সৃষ্টি ওই সমাজের সকল সত্যের একটা অবসাদগ্রস্ত বৈরাগ্য ও চরিত্রগত স্বতন্ত্রতা হইতে। কোন বৈদেশিক শক্তির পর-রাজ্য-লোলুপতার শিকারে পরিণত হওয়া সেই দেশ ও সেই সমাজের বিধিলিপি না হইয়া কি পারে?’
পলাশি যুদ্ধের ট্রাজেডিস্বরুপ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ দুটি প্রদেশ বাংলা ও বিহারের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়। চতুর বেনিয়ারা নানা কৌশলে শাসন ও শোষণ চালাতে থাকে। ‘চতুর্থ পার্লামেন্টারি রিপোর্ট, ১৭৭৩’ থেকে জানা যায়, ‘১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট দ্বারা নিযুক্ত অনুসন্ধান কমিটি কর্মচারীদের উৎকোচ গ্রহণের যে তালিকা প্রস্তুত করেন তাহাতেই দেখা যায়, ১৭৫৭ হইতে ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলা ও বিহার হইতে মোট ৬০ লাখ পাউন্ড, অর্থাৎ নয় কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করিয়াছিল।’
২.
ইংরেজ শাসন ভারতের কৃষি-সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। রাজস্ব আদায় আগে হতো গ্রাম-সমাজ থেকে, কোনো ব্যক্তির নিকট নয়। ইংরেজ বেনিয়ারাই সর্বপ্রথম ব্যক্তিগতভাবে রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রচলন করাসহ রাজস্ব হিসাবে ফসলের বদলে মুদ্রাপ্রথা প্রচলন করে।
তারা মোগল যুগের জমিদার বা রাজস্ব আদায়কারী গোমস্তাদেরই জমির মালিক বলে ঘোষণা করে। যেখানে জমিদার বা গোমস্তা ছিল না, সেখানে গ্রাম-সমাজের প্রধান ব্যক্তিদের জমির মালিক করা হয়। এরা কৃষকের কাছ থেকে ইচ্ছামতো খাজনা ও কর আদায় করে সেখান থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ইংরেজদের দিতো।
খেয়াল-খুশীমতো রাজস্ব আদায়ের ফলে বাংলা ও বিহারের রাজস্ব মোগলযুগের শেষ সময়ের রাজস্ব অপেক্ষা দ্বিগুণ হয়। ১৭৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজস্ব আদায় হয় এক কোটি ২৩ লাখ টাকা, ১৭৬৫-৬৬ খ্রিষ্টাব্দে যা বেড়ে হয় দুই কোটি ২০ লাখ টাকা। ভূমি রাজস্ব, কর্মচারীদের উৎকোচগ্রহণ ও ব্যক্তিগত ব্যবসায় (প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল লুণ্ঠন। বাংলা ও বিহারের জনসাধারণের টাকায় নামমাত্র মূল্যে এ দেশের পণ্য ক্রয় করে ইউরোপের বাজারে অধিক মূল্যে বিক্রয় করা হতো।) যে মুনাফা পেতো, তার পরিমাণও ছিল অবিশ্বাস্য। কার্ল মার্কস, রেজিনাল্ড রেনল্ডসের মতো লেখকরা এই ব্যবসাকে বলেছেন ‘প্রকাশ্য দস্যুতা’।
ইংরেজদের শাসন ও শোষণের মাত্রা ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ফলে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ও বিহারে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষের ভয়াল ছায়া। যার নিষ্ঠুর থাবায় অসংখ্য মানুষ নির্মম মৃত্যুর শিকার হন। ইংরেজ সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষ ১৭৭৬ সালে মহাদুর্ভিক্ষে রূপ নেয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষে চাষিরা ক্ষুধার জ্বালায় তাদের সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হয়, কোথাও কোথাও জীবিত মানুষ মৃত মানুষের মাংস খেয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে। নদীর তীর মৃত ও মুমূর্ষু মানুষের ভাগাড়ে পরিণত হয়। মারা যাওয়ার আগেই মুমূর্ষু মানুষকে শিয়াল-কুকুরে খাওয়ার ঘটনাও ঘটে।
৩.
মানব সভ্যতার ইতিহাসে, শাসন-শোষণের ঘৃণ্য নজির যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিপ্লবী চেতনার উদাহরণ। স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ এই সত্যেরই নির্মোহ উচ্চারণ। বঙ্গদেশও তার ব্যতিক্রম নয়, বরং এখানে সংঘটিত হয়েছে বিপ্লবের এমন ইতিহাস, যা ভিন্নমাত্রার, স্বতন্ত্র চেতনায় সমুজ্জ্বল, অনন্য গৌরবের স্মারকবাহী।
ভারতে ইংরেজ বেনিয়ার শাসনে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষকসমাজ। স্থান বিচারে বাংলা, তারপর বিহারসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল। আবার ঐতিহাসিক সত্য হলো, প্রথম সাহসী আঘাত, অভিঘাত ও প্রতিবাদী বিপ্লবগুলোও হয় বাংলায়। যা সংগঠনের কেন্দ্রে ছিল বাংলার কৃষককুল। যার সূচনা হয়েছিল সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দিয়ে। বঙ্গ (বাংলা) ও বাংলায় ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে এই বিপ্লবের শুরু। ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলা তথা ভারতের কৃষক ও কারিগরদের প্রথম বিদ্রোহ ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়িত্ব ছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সমকালেই বঙ্গদেশের উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জনপদ রংপুরে সংঘটিত হয় অন্য ধরনের এক কৃষক বিদ্রোহ, ইতিহাসে যা ‘রংপুর বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।
এতে ইংরেজ বণিক ও এদেশীয় শোষকদের প্রতিনিধি ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের আশীর্বাদপুষ্ট দেবী সিংহ । অন্যদিকে ছিলেন নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের নেতা, কৃষক সমাজের প্রতিনিধি বিপ্লবী নূরুলউদ্দিন।
৪.
মুর্শিদাবাদ কাহিনী বইয়ে রংপুর বিদ্রোহের বিবরণ রয়েছে, ‘যখন চাষীদের উপর এই কর বৃদ্ধি ও তাহাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার উপর পাশবিক অত্যাচার অবাধে চলিতে লাগিল, যখন তাহারা বন্য পশুর মত দলে দলে বনে বনে ভ্রমণ করিয়াও অত্যাচারের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইল না, চক্ষুর সম্মুখে নিজেদের কুঠার ও যথাসর্বস্ব অগ্নিমুখে ভস্মীভূত হইতে লাগিল, তখন আর তাহারা স্থির থাকিতে পারিল না। কাজেই এই সমস্ত ভীষণ অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া উত্তরবঙ্গের প্রজাগণ দলবদ্ধ হইয়া ব্যাপক বিদ্রোহ আরম্ভ করিল।’
১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দের শেষ ভাগে ভেতরে ভেতরে কৃষকদের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে ওঠে । উত্তরবঙ্গের কৃষককূল অনিবার্য ধ্বংস থেকে আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসেবে অন্যায় শোষণ ও শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে। এমনকি তারা সভা-সমিতিও গঠন করে।
রংপুর বিদ্রোহ প্রকাশ্য রূপ নেয় ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। কৃষকেরা তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার বন্ধে নিয়মতান্ত্রিক পথেই সমাধান চায়। সুপ্রকাশ রায়ের ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম বইয়ে উল্লিখিত হয়েছে, ‘কৃষকগণ ইংরেজ অনুচর দেবী সিংহের শোষণ-উৎপীড়নের প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল। রংপুরের কালেক্টরের নিকট তাহাদের দাবি সম্বন্ধে একখানি আবেদনপত্র পেশ করিয়া এই দাবি পূরণের জন্য সময় নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইল। কিন্তু কালেক্টর দাবি পূরণের জন্য কোন চেষ্টাই করিলেন না, ইহার পর কৃষকগণ সশস্ত্র বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল। তাহারা কালেক্টরকে জানাইয়া দিল, তাহারা আর খাজনা দিবে না এবং এই শাসন মানিয়া চলিতেও প্রস্তুত নহে।’
৫.
কৃষকেরা বিদ্রোহের লক্ষ্যে সংগঠিত হয়। বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য নিজেদের মধ্য থেকে নূরুলউদ্দিন নামক এক ব্যক্তিকে নেতা নির্বাচন করেন। শুধু নেতা নির্বাচন নয়, কৃষকেরা তাঁকে নবাব বলেও ঘোষণা দেন (গেজেট অব রংপুর ডিস্ট্রিক্ট)।
কৃষকবিপ্লবী নুরুলউদ্দিন স্বতঃস্ফূর্ততায় এই দায়িত্ব নেয় এবং দয়াশীল নামের একজন প্রবীণ কৃষককে দেওয়ান নিযুক্ত করেন। নূরুলউদ্দিন এক ঘোষণাপত্রে দেবী সিংহকে কর না দেওয়ার আদেশ দেন। বিদ্রোহের ব্যয় পরিচালনার জন্য ‘ডিংখরচা’ নামে চাঁদা আদায় করেন। এভাবে রংপুর, দিনাজপুর, কুচবিহারসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব কৃষক নূরুলউদ্দিনের নেতৃত্বে দেবী সিংহের বর্বর শোষণ-উৎপীড়নের প্রতিশোধ গ্রহণ ও এই অঞ্চল থেকে ইংরেজ শাসন উচ্ছেদের লক্ষ্যে প্রস্তুত হন।
১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতেই বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্রোহী কৃষকেরা রংপুর থেকে দেবী সিংহের কর সংগ্রহকারীদের বিতাড়িত করে, অনেক কর্মচারী খুনও হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, টেপা, ফতেপুর ও বাকলায় বিদ্রোহ ভীষণ আকার ধারণ করে। টেপা জমিদারির নায়েব বিদ্রোহে বাধা দিতে এসে নিহত হন। কাকিনা, কাজিরহাট, ডিমলা এলাকায়ও একইরকম ঘটনা ঘটে। ডিমলার জমিদার গৌরমোহন চৌধুরীও বিদ্রোহী কৃষকদের বাধা দিতে এসে নিহত হন। বিদ্রোহীদের সাফল্যে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষ করে দিনাজপুর, কুচবিহারের কৃষকেরাও ‘নবাব’ নূরুলউদ্দিনের বাহিনীতে যোগ দিয়ে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে।
বিপ্লব যখন উত্তুঙ্গে, তখন রংপুরের কালেক্টর গুডল্যাড দেবী সিংহকে রক্ষায় ও কৃষকদের ন্যায্য দাবি পর্যুদস্ত করার জন্য কয়েক দল সিপাহি পাঠান, যার নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড। বিদ্রোহ দমনে তাঁরা বর্বরের ভূমিকায় অংশ নেন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং মানুষ দেখামাত্রই পশুর মতো গুলি করে।
যার ধারাবাহিকতায় ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি দেবী সিংহ ও ইংরেজ শাসনের প্রধান ঘাঁটি মোগলহাটে বন্দরের ওপর কৃষকেরা মরণপণ আক্রমণ করে এবং ভয়াবহ এক যুদ্ধ হয়। বিদ্রোহের নায়ক ‘নবাব’ নূরুলউদ্দিন গুরুতর আহত হয়ে শত্রুদের হাতে ধৃত হন এবং তাঁর বিশ্বস্ত দেওয়ান দয়াশীল নিহত হন। কিছুদিন পর নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে ‘নবাব’ নূরুলউদ্দিন মারা যান।
৬.
ইতিহাসের সত্য হলো, রংপুর বিদ্রোহে ‘নবাব’ নূরুলউদ্দিন বাহিনীর পরাজয়ের পেছনে ছিল ইংরেজ বাহিনীর চতুরতা। সম্মুখযুদ্ধের পরিবর্তে তারা বেছে নিয়েছিল ঠকবাজির কৌশল।
মোগলহাটের যুদ্ধের সময় ‘নবাব’ নূরুলউদ্দিনের বাহিনী ছিল পাটগ্রামে। ম্যাকডোনাল্ড সিপাহি বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথে নবাব বাহিনীর শক্তি, সাহস ও বীরত্বের কথা শুনে ভীত হন। তৎক্ষণাৎ তিনি সিপাহিদের যুদ্ধের পোশাকের ওপর সাধারণ পোশাক পরে ছদ্মবেশ ধারণের নির্দেশ দেন। সিপাহিরা রাতের অন্ধকারে পাটগ্রামের নিকটবর্তী হন এবং বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ঘিরে ফেলে এবং ভয়ংকর এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যে যুদ্ধে ‘নবাব’ নূরুলউদ্দিনের বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় ঐতিহাসিক এক কৃষক বিদ্রোহের। আর রংপুর অঞ্চলে নতুন করে শুরু হয় পৈশাচিক তাণ্ডব, লুণ্ঠন, ও অন্যায়-অত্যাচারের বর্বরতম এক অধ্যায়।
৭.
রংপুর বিদ্রোহ সমাপ্ত হলেও অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের কাছে মাথানত না করার ‘নবাব’ নূরুলউদ্দিনের চেতনা, বিপ্লবের মন্ত্রে জাগরণের প্রেরণা ছড়িয়ে পড়ে রংপুর, উত্তরাঞ্চল, বঙ্গদেশ (বাংলা) থেকে গোটা ভারতে। নূরুলউদ্দিনকে উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা দিয়েছিলেন ‘নবাব’ উপাধি। ওরা মাটির উপাসনা করে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। বাসনা ছিল তাই নিজেদের একজন নবাব—মাটির নবাব। যে বোঝে কৃষকের কথা, জানে মাটির ভাষা। যেমন ছিলেন সতীর্থ বিপ্লবী, কৃষক নেতা নূরুলউদ্দিন। সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্যে যিনি হয়েছেন নূরলদীন (লেখকের মতে, ‘আমি ব্যবহার করেছি, নূরলদীন, রংপুরের সাধারণ মানুষেরা যেমনটি উচ্চারণ করে’)। মাটির নবাবের সংলাপে সেখানে দেখা যায় মাটির মানুষের চিরন্তন চাওয়া, কৃষি ও কৃষকের নিরাভরণ আকাঙ্ক্ষা: পুুন্নিমার চান নয়, অনাহারী মানুষেরা চায়/ ধানের সুঘ্রাণে য্যান বুক ভরি যায়,/ পুন্নিমার মতো হয় সন্তানের মুখ রোশনাই।/ ইয়ার অধিক মুঁই কিছু চাঁও নাই। অন্যত্র, এক এ নূরলদীন যদি চলি যায়,/ হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়। … এ দ্যাশে হামার বাড়ি উত্তরে না আছে হিমালয়/ উয়ার মতন খাড়া হয় য্যান মানুষেরা হয়।/ এ দ্যাশে হামার বাড়ি দক্ষিণেতে বঙ্গোপসাগর,/ উয়ার মতন গর্জি ওঠে য্যান মানুষের স্বর।/ এ দ্যাশে হামার বাড়ি পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র আছে,/ উয়ার মতন ফির মানুষের রক্ত য্যান নাচে।/ এ দ্যাশে হামার বাড়ি পশ্চিমেতে পাহাড়িয়া মাটি, উয়ার মতন শক্ত হয় য্যান মানুষের ঘাঁটি।