‘আসমানী’ কবি জসীমউদ্দীনের অমর কবিতা। বিদ্যালয়ে পাঠ্য বলে প্রায় সবার মানসপটেই আসমানীর ছোটবেলার ছবি আঁকা হয়ে আছে। এই আসমানী কল্পনার কেউ নয়, কবি বাস্তবের এক আসমানীকে নিয়েই লিখেছিলেন কবিতাটি। কেমন আছেন সেই আসমানী, কোথায় তাঁর দেখা মিলবে? জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া সেই আসমানীর খোঁজ জানাচ্ছেন সাহাদাত পারভেজ
আসমানীকে দেখতে হলে যেতে হবে রসুলপুরে। তিনি তাঁর নিজের বয়স বলতে পারেন না। তবে ধারণা আশির কাছাকাছি হবে। অশীতিপর আসমানী লাঠিতে ভর করে হাঁটেন। সোনালি গায়ের বরণে বয়সের ভাঁজ। কপালে বলিরেখা। ভোমরকালো চোখ দুটোতে আবছা দেখেন। কানে কম শোনেন অনেক দিন ধরেই। হাত-পায়ে বল নেই। গলার স্বর ক্ষীণ। পেটে ব্যথা চিন চিন করে সারাক্ষণ। ক্ষুধা আর দারিদ্র্য যেন নিত্যসঙ্গী। অভাবের সংসারে চিকিৎসক ডেকে ওষুধ কেনার পয়সা নেই তাঁর।
ফরিদপুর উপজেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের রসুলপুর খুব সুন্দর একটা গ্রাম। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের শিবরামপুর সেতু পেরিয়ে পূর্ব দিকে মাইল খানেক গেলে চোখে পড়বে এক বাঁশবাগান। বাগানের কাঁচা রাস্তা ধরে এগোলে দেখা মিলবে একটি টিনের ঘর। এ ঘরেই বসবাস করেন কবিতার আসমানী।
‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমুদ্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। বাড়িতো নয় পাখির বাসা—ভেন্না পাতার ছানি, একটুখানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি।’ সমস্ত কবিতায় কবি সেই সময়ের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রতিচ্ছবি বিধৃত করেছেন। কাব্যিক ও শৈল্পিক সুষমায় আসমানীর আবির্ভাব ঘটেছে দারিদ্র্যের প্রতীক হিসেবে। আর রহিমুদ্দীর বাড়ি যেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি খণ্ডচিত্র। ১৯৪৯ সালে এক পয়সার বাঁশী কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয় কবিতাটি। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে আসমানীর জীবনের তেমন কিছুই পরিবর্তন হয়নি।
আসমানী থাকেন তাঁর ছোট মেয়ে জোছনার সঙ্গে। জোছনা বিধবা। তাঁর ছেলে সবুজ রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। রোজ পান ১৭০ টাকা। এ দিয়েই চলে জোছনার দুই সন্তানসহ আসমানীর সংসার। আসমানীর দুই মেয়ে—সফুরা ও তাসলিমা থাকেন পাশের দুই ঘরে। অন্য পাঁচ মেয়ে—নসি বেগম, রেজিকা, নূরজাহান, আলেয়া ও আমেনা আছেন স্বামীর সংসারে। চার ছেলে—হারুন মণ্ডল, সোহরাব, রাজ্জাক ও হাকিম কৃষিকাজ করেন। নাতিপুতি সব মিলে ৫৫ জন। আসমানীরা সাত ভাইবোন। সবার ছোট বলে বাবা আরমান মল্লিক মেয়ের নাম রেখেছিলেন আসমানী। সবাই মারা গেছেন। কেবল তিনিই বেঁচে আছেন কালের সাক্ষী হয়ে।
রসুলপুর আসমানীর শ্বশুরবাড়ি। নয় বছর বয়সে বউ হয়ে আসেন এ গ্রামে। বাবার বাড়ি পার্শ্ববর্তী ভানুরজঙ্গা গ্রামে। রসুলপুর গ্রামের মমিন মণ্ডলের ছেলে হাসেম উদ্দিন মণ্ডলের সঙ্গে বিয়ে হয় আসমানীর। আসমানীর স্বামী মারা গেছেন ২৫ বছর আগে। রসুলপুর গ্রামে মমিন মণ্ডলের বাড়িতে আসতেন মানিকগঞ্জের পীর শাহ্ আবদুর রহিম ওয়াসি। পুরো মণ্ডল পরিবার ছিল তাঁর ভক্ত। একসময় তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ফলে রসুলপুর গ্রামের মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এভাবেই মণ্ডলবাড়ি হয়ে যায় রহিমুদ্দীর বাড়ি।
অন্যদিকে কবি জসীমউদ্দীনের বড় ভাই মফিজউদ্দীনের শ্বশুরবাড়িও রসুলপুর গ্রামে। কবির আত্মীয় বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণে আসমানীর বাড়ি। কবির আত্মীয় মজিদ ব্যাপারীর বাড়িতে মাঝেমধ্যেই বসত লোকজলসা। কবি প্রায়ই অংশ নিতেন জলসায়। এই বাড়িতে বসেই কবি লিখেছিলেন আসমানী কবিতাটি। কবি তা পড়ে শুনিয়েছিলেন গ্রামবাসীকে। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে কবির শততম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আসমানীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি সংস্থা প্রশিকা আসমানীর থাকার ঘরটি করে দেয়। এগুলোই আসমানীর সারা জীবনের প্রাপ্তি।
সন্ধ্যা নামে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে ওঠে। জানালা দিয়ে বাইরের আলো দেখেন আসমানী। কিছুক্ষণ পর মাথা রাখেন বালিশে। এভাবে রাত কেটে যায়, তবু সময় কাটে না আসমানীর। ফেরার বেলায় এপাশ-ওপাশ তাকাই। আসমানীর বাড়ির সামনের পদ্মপুকুরটি দেখা গেল। জল নেই তাই এই পুকুরে বহু বছর ধরে পদ্ম ফোটে না।