হারকিউলিয়ান টাস্ক শব্দগুচ্ছটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কোনো কাজ প্রায় অসম্ভব মনে হলে আমরা মাঝে মধ্যে ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে বলে থাকি: ওরে বাবা এ তো দেখছি হারকিউলিয়ান টাস্ক। বোঝাই যাচ্ছে কথাটির উত্স হারকিউলিসের দেশ গ্রিসে, হাজার হাজার বছর আগে, তারই সময়ে এবং তার সঙ্গেই জড়িত কিংবদন্তির শিকড় বেয়ে।
দেবীদের রানী, দেবরাজ জিউসের স্ত্রী এবং মহাবীর হারকিউলিসের সত্মা হেরা মহাক্ষিপ্ত হয়ে একবার হারকিউলিসের প্রতি এমন রোষাগ্নি বর্ষণ করলেন যে, হারকিউলিস একেবারে উন্মাদ হয়ে গেলেন; যার আবেশে হারকিউলিস তাঁর পুত্র, কন্যা এবং প্রিয় পত্নী মেগরাকে হত্যা করলেন। সংবিত্ ফিরে পেয়ে হারকিউলিস একদিকে শোকে মুহ্যমান, অন্যদিকে পরিবার হত্যার মহাপাপে জর্জরিত। পাপ মোচনের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবশেষে তিনি ডেলফির অ্যাপোলো মন্দিরের দৈবজ্ঞ-পুরোহিত পিথিয়ার শরণাপন্ন হলেন। পিথিয়া তাকে পরামর্শ দিলেন, তাইরিন গিয়ে মাইসিনের রাজা ইউরিসথিয়াসের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে। রাজার অধীনে ১২ বছর থেকে তার দেয়া সব হুকুম তামিল করতে হবে তাকে। তবেই হবে তার পাপক্ষয়।
হারকিউলিসের কাছে এ পরামর্শ ছিল তিক্ত বড়ি গেলার মতো। কারণ মাইসিনের সিংহাসনের আসল উত্তরাধিকারী ছিলেন তো তিনিই। কিন্তু হেরা ও জিউসের স্বর্গীয় দ্বন্দ্বের পাকচক্রে তাকে তা হারাতে হয়েছে। তাছাড়া শৌর্যবীর্যে তিনি ইউরিসথিয়াসকে তার নখের যোগ্যও মনে করতেন না। এহেন ইউরিসথিয়াসের দাসগিরি করতে হবে নিজের পাপ স্খলনের জন্য! তবে সান্ত্বনা ছিল একটাই, ইউরিসথিয়াসের অভিলাষমতো কাজগুলো সম্পাদন করতে পারলে তিনি অমরত্ব লাভ করবেন। এদিকে ইউরিসথিয়াসও তার চির প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাগে পেয়ে বেছে বেছে তার জন্য দশটা কঠিন কাজ জোগাড় করলেন, তার কোনো কোনোটায় মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত ছিল। এ দশ কাজ শেষ পর্যন্ত বারোতে গিয়ে ঠেকেছিল, তবে সে আরেক প্রসঙ্গ। হারকিউলিসের এ বিখ্যাত বারো কাজের উপাখ্যান প্রাচীন ইউরোপে এতই প্রসিদ্ধি পায় যে, প্রায় প্রত্যেক ভাষায়ই কঠিন অথবা বিপদসঙ্কুল কাজের নাম হয়ে যায় হারকিউলিসের কাজ, ইংরেজিতে যা হারকিউলিয়ান টাস্ক। অবশ্য মূল গ্রিক ভাষায় শব্দটি হলো হেরাক্লিয়াস এথলয়, যার সঠিক অনুবাদটি হলো হারকিউলিয়ান লেবার। তা সে লেবারই হোক আর টাস্কই হোক, তার পাঁচ নম্বরের কাজটি ছিল একটু বিদ্ঘুটে ধরনের, আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই কোনো বীরের কাজ নয়। আর এ পাঁচ নম্বর কাজটি নিয়েই আমাদের আজকের রচনা।
হারকিউলিসকে একদিনের মধ্যে একটা গোয়ালঘর পরিষ্কার করে দিতে হবে। শুনে হাসি এলেও কাজটা কিন্তু মোটেই তেমন হাসির নয়। এটি একটি রাজকীয় গোয়ালঘর, যার মালিক হলেন রাজা অজিয়াস। গোয়ালঘরে তিন হাজার গরুর বাস। তিন হাজার গরু সামলানো মহাবীর হারকিউলিসের জন্য হয়তো তেমন কঠিন কিছু নয়, কিন্তু যে খবরটি আঁতকে ওঠার মতো, তা হলো তিন হাজার গরু ৩০ বছর ধরে এ গোয়ালঘরে মলমূত্র জমা করে যাচ্ছে, এর মধ্যে একদিনও ঘরটি পরিষ্কার করা হয়নি। ধারণা করা যায়, কত গোবর জমেছিল এ ৩০ বছরে! রাজার গরুগুলোর নিশ্চয়ই খাবারের অভাব ছিল না, তাই দেয়ার বেলায়ও তাদের কার্পণ্য করার কথা নয়। হারকিউলিস অনেক মানুষ, দেবতা, দৈত্য-দানবের সঙ্গে লড়েছেন এবং জিতেছেন। কিন্তু অন্য পক্ষে যেখানে নিশ্চল নিথর গোবরের পাহাড়, সেখানে তো তার ভুবনখ্যাত পেশি আর লক্ষ্যভেদী বর্শার কোনোই ভূমিকা নেই। তাহলে? এবার মহাবীর তার বাহুবলের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিবলেরও শরণাপন্ন হলেন। তিনি গোয়ালঘরের দুদিকের দেয়াল ভেঙে দুটি বড় পথ বের করলেন। অদূরেই বয়ে যাচ্ছিল দুটি খরস্রোতা নদী— আলফিয়াস আর পেনিয়াস। খাল কেটে দুই নদীর পানি বইয়ে দিলেন গোয়ালঘরের ভাঙা দেয়ালের মধ্য দিয়ে। তার পর তো শুধু বসে বসে দেখা। সূর্যাস্তের আগেই অজিয়াস রাজার গোয়ালঘর এক্কেবারে ধুয়ে সাফ!
হারকিউলিসের গোয়ালঘর প্রকল্পই জগতের প্রথম হাইড্রো- ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়াস কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা গবেষণা করেছেন, এমন তথ্য আমার জানা নেই। তবে আধুনিককালের এক হাইড্রো-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়াস অজিয়াসের গোয়ালঘরের চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি বস্তুর সমাবেশ ঘটিয়েছে, এমন খবর অতিসম্প্রতি কাগজে-টিভিতে দেখা গেছে। খবরে জানা যায়, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, ফারাক্কা বাঁধের ফলে গঙ্গায় পলি জমে জমে তলদেশ এতটাই উঁচু হয়ে গেছে যে, এর ফলে বিহারে প্রতি বছর বন্যা হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় তার মতে, ফারাক্কা বাঁধটাই ভেঙে ফেলা। কথাটি কোনো মেঠো বক্তৃতা নয়, একেবারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃরাজ্য কাউন্সিল সভায় রীতিমতো প্রস্তাব; যেখানে উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। যথেষ্ট উপাত্ত-পরিসংখ্যানের সহায়তা নিয়ে আটঘাট না বেঁধেই এমন একটি প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন বলে মনে হয় না। একেই বোধহয় বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। আমি যখন খুব ছোট, নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যাস তখনো গড়ে ওঠেনি, তখন একবার কোনো এক পত্রিকায় দেখেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তানের নাকের ডগায় গঙ্গায় বাঁধ দেয়ার পাঁয়তারা করছে ভারত। পাকিস্তান সরকারের এ ব্যাপারে আশ্চর্য রকমের গাছাড়া ভাব দেখে পত্রিকার মন্তব্য ছিল: হয়তো বাঁধটি পশ্চিম পাকিস্তানের সংলগ্ন হলে সরকার এতটা নির্বিকার থাকতে পারত না। তার পর অবশ্য কিছুটা দৌড়ঝাঁপ হয়েছিল, তবে লোক দেখানো না হলেও তা ছিল একেবারেই অন্তিমকালীন প্রয়াস। তাই বলা যায়, বাঁধটা আমাদের ওপর চেপে বসেছে অনেকটা নিয়তির বিধানের মতো। স্বাধীনতার পর যখন আমাদের নিজেদের হয়ে কথা বলার যোগ্যতা হলো, তখন তো সব শেষ। ফারাক্কা তখন ফিতা কেটে চালু হওয়ার পর্যায়ে। এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার ভারতের সঙ্গে ৪৪ হাজার কিউসেক পানির হিস্যা আদায় করে এক চুক্তি করেছিল, (আর হুগলির জন্য বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার কিউসেক)। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চুক্তিটি আর কার্যকর থাকেনি। বস্তুত এর পরই শুরু হয় গঙ্গার পানির জন্য আমাদের হাহাকার। তবে বাংলাদেশে গঙ্গার পানি ইস্যুতে আন্দোলনগোছের যা কিছু হয়েছে, তার অধিকাংশই ছিল বৃহত্তর ভারতবিরোধিতার প্রেক্ষাপটে। ফলে এত বড় পরিবেশ বিপর্যয়ের পরও এ দেশে ফারাক্কা নিয়ে বৃহত্ পরিসরে কার্যকর কোনো জনমত দানা বাঁধতে দেখি না।
তাই বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর মতো ব্যক্তিত্বের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য স্বর্গীয় উপহার বৈকি! একটু সাবধানে হলেও এপারে আমরা যে একটু নড়েচড়ে বসেছি, তার আভাসও পত্রিকায় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটি কী? কেনইবা এত সাধের আর প্রেস্টিজের ফারাক্কা বাঁধ এত দিন পর এমন বৈরী হয়ে উঠল যে, তাকে ভেঙে ফেলতে বলতেও মুখ্যমন্ত্রীর মতো মানুষের বুক কাঁপে না?
ব্যাপারটা ঠিক অজিয়াসের গোশালার মতোই। সেখানে তিন হাজার গরু ৩০ বছর ধরে শুধু খেয়েছে আর টনকে টন গোবরের স্তরের পর স্তর বিন্যাস করে চলেছে। সেটা পরিষ্কার করতে দরকার পড়েছিল হারকিউলিসের মতো মহাবীরের। তিনি তাঁর কিংবদন্তিশক্তি আর হেলেনীয় বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে কাজটি উদ্ধার করেছিলেন একদিনে। এবার ব্যাপারটা হলো ৫০ বছরের। সেই ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিলে বাঁধের যাত্রা, তার পর প্রতি বছর উজান থেকে বয়ে আনা লাখো কোটি টন পলি জমা হয়েছে গঙ্গার বুকে। কারণ শুষ্ক মৌসুমে বাঁধের কারণে নদীর পানি যখন থমকে দাঁড়ায়, তখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বালিকণাও সে ধরে রাখতে পারে না। সর্বশেষ জরিপমতে গঙ্গা উত্তর থেকে প্রতি বছর পলি বয়ে আনে প্রায় ৭৩৬ মিলিয়ন টন, আর তা থেকে ফারাক্কার উজানে জমা পড়ে প্রায় ৩২৮ মিলিয়ন টন। তাই ৫০ বছরে ‘ক্ষুদ্র বালিকার কণা’ মা গঙ্গার জঠর এতটাই পূর্ণ করে ফেলেছে যে, বর্ষার সবটুকু বারিরাশি তিনি আর ধারণ করতে পারেন না, বাড়তিটা উগরে দেন প্রবল বন্যার আকারে। পুরাণমতে দেবী গঙ্গার মর্ত্যে আগমন ঘটেছিল সগর রাজার ষাট হাজার পুত্রকে জীবন দানের জন্য, কিন্তু আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে পড়ে তিনিই হয়ে পড়েছেন জীবনশঙ্কার প্রবল এক কারণ।
যা-ই হোক, বিহারকে বন্যামুক্ত করতে নীতিশ কুমার এখন প্রকারান্তরে একজন হারকিউলিসেরই খোঁজ করছেন, কিংবা তার চেয়েও মহাবলবান কাউকে। কারণ ফারাক্কাকে গুঁড়িয়ে দেবে এমন মহাবীর কে আছে আধুনিক ভারতে? তাই তিনি প্রস্তাব করছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর সামনে, একমাত্র যার শক্তিকেই হারকিউলিসের মহাশক্তির সঙ্গে তুলনা করা যায়। আর বুদ্ধির জন্য প্রস্তাব করেছেন ‘একটা কার্যকর জাতীয় পলি ব্যবস্থাপনা নীতির’। আশা হারকিউলিসের মতোই একটা বুদ্ধি বের করবে এ ব্যবস্থাপনা নীতি, যার মাধ্যমে অর্ধশতাব্দীর জঞ্জাল থেকে গঙ্গা তো পরিত্রাণ পাবেই; ভবিষ্যতে অন্যান্য নদীতেও যাতে পলি সমস্যার উদ্ভব না ঘটে, তারও একটা সুরাহা হবে।
একটা লাখ টাকার প্রশ্ন এ প্রসঙ্গে এসে যায়। মাত্র তো ৫০ বছর; এর মধ্যেই গঙ্গার এ হাল হবে, বাঁধের জন্মলগ্নে এটা কি কেউ আঁচ করতে পারেনি? ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, পেরেছিলেন বটে কেউ কেউ। তবে তত্কালীন ভারতের অবিসংবাদিত নেতা জওহরলাল নেহরুর বৃহত্ প্রকল্প আর উন্নয়নকে সমার্থক করে ফেলার প্রবণতা, আর দেশব্যাপী প্রবল পাকিস্তান বিদ্বেষের ঢেউ তাঁদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়নি। এ রকমই একজন হলেন কপিল ভট্টাচার্য, তত্কালীন পশ্চিমবঙ্গের সেচ ও জলপথ ডিরেক্টরেটের সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, ফারাক্কার মূল লক্ষ্য অর্জিত তো হবেই না, উল্টো তা আরো নানা জটিলতার সৃষ্টি করবে। ফারাক্কা বাঁধের মূল লক্ষ্য ছিল— গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে ভাগীরথী দিয়ে হুগলি নদীতে ফেলা; যার মাধ্যমে হুগলি নদীর মোহনায় পলি জমা রোধ করে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা করা হবে। যারা ওপারের খবরাদি একটু-আধটু রাখেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন, কলকাতা বন্দরের নাব্যতা ধরে রাখার জন্য কলকাতা হাইকোর্টকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ২০১৩ সালের এক কোর্ট রুলিংয়ের কল্যাণে বন্দরের ড্রেজিং ব্যবস্থা টিকে আছে; কারণ কেন্দ্রীয় ড্রেজিং সংস্থা এত টাকা খরচ করে বন্দর বাঁচিয়ে রাখতে আর আগ্রহী নয়। একটা পরিসংখ্যান দিলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে বুঝতে সুবিধা হবে। ফারাক্কা নির্মাণের আগে কলকাতা বন্দরে ড্রেজিং করতে হতো ৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন ঘনমিটার আর বর্তমানে করতে হয় ২১ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন ঘনমিটার। তাই ফারাক্কার মূল লক্ষ্য যে অর্জিত হয়নি, এটা বুঝতে এখন আর বিশেষজ্ঞের দরকার হয় না। গ্রামেগঞ্জে এ অবস্থাটাকেই বোধহয় বলে ‘মারও খেলাম, পেটও ভরল না’। একদিকে মূল লক্ষ্যটাও অর্জিত হলো না, অন্যদিকে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো স্থায়ী বন্যার ব্যবস্থা। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মরুকরণ প্রক্রিয়া আর সুন্দরবনের মৃত্যুঘণ্টার কথা না হয় এ প্রসঙ্গে নাই এল। আরো খবর আছে! শুনছি গোটা ফারাক্কা বাঁধটাই অকার্যকর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। নদীতল ভরাট হয়ে যাওয়ায় স্রোতের চাপ পড়ছে দুই কূলে। তবে দক্ষিণে রাজমহল পাহাড়ি অঞ্চলের পাথুরে মাটির ওপর কোপ বসাতে না পারলেও স্রোতের তোড়ে উত্তর পাড়ের নরম মাটি প্রবল ভাঙনের মুখে। ভারতীয় পত্রপত্রিকারই খবর, ফারাক্কাকে পাশ কাটিয়ে গঙ্গা তার ১৫ শতাব্দীর পুরনো পথ ধরে প্রবাহিত হওয়ার তোড়জোড় করছে।
এ লেজেগোবরে অবস্থাটা কেন হলো? ওই যে বললাম, ভারতে তখন একদিকে নেহরুর বিরাট বিরাট স্বপ্ন-প্রকল্প বাস্তবায়নের যুগ, আর তার সঙ্গে দেশপ্রেমের দুকূল ছাপানো জোয়ার। সেই জোয়ারের তোড়ে ভেসে গেলেন কপিল ভট্টাচার্যের মতো প্রাদেশিক ইঞ্জিনিয়ার; যিনি এ প্রতিটি বিষয়ে ৫০ বছর আগেই নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কলকাতা পোর্টের মরণদশা, বিহারে পৌনঃপুনিক বন্যা আর উত্তরবঙ্গের ভাঙন কোনোটাই তিনি বাদ দেননি। কিন্তু পুরস্কারের বদলে তিনি পেয়েছিলেন তিরস্কার। সে সময়কার পানিমন্ত্রী কেএল রাও তাকে বলেন ‘বিশ্বাসঘাতক’ আর বাংলা আনন্দবাজার পত্রিকা আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে তাকে বানিয়ে দিল ‘পাকিস্তানের চর’। শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয় তাকে।
ফারাক্কার সমস্যা ভারত কীভাবে সমাধান করবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ জাতীয় গর্বের প্রতীক ফারাক্কাকে গুঁড়িয়ে দেবে, এমন মহাশক্তিধর হারকিউলিসের আবির্ভাব এখনো ভারতে ঘটেনি। তার পর রয়ে গেছে নানা পক্ষ ও স্বার্থ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তো এরই মধ্যে আওয়াজ উঠেছে ফারাক্কার পক্ষ নিয়ে। তাই ফারাক্কার কী হবে, সে প্রশ্নের চেয়ে গঙ্গার কেন এ হাল হলো, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটাই বোধহয় এ মুহূর্তে বেশি প্রাসঙ্গিক। অন্তত এখন আমরা জানি অনেক টেকনিক্যাল কারণ ছিল এর মূলে, যার প্রায় সবক’টিই কপিল ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আসল কারণটি তো দার্শনিক— প্রকৃতির সঙ্গে আমরা কিরূপ আচরণ করব, তার মধ্যেই নিহিত। অনেকে বলেন, তার ওপর যত অত্যাচার হয়, প্রকৃতি নির্মমভাবে তার প্রতিশোধ নেয়। আমি বলি না, মা ধরিত্রী আমাদের শত অত্যাচার নীরবে সহ্য করেন, তিনি কোনো প্রতিশোধ নেন না। কিন্তু তার ধারণক্ষমতা তো অসীম নয়, একসময় তা উপচে পড়বেই। সেটাকেই যদি প্রতিশোধ বলি, তাহলে বলতে হবে সীমা অতিক্রম করলে প্রকৃতি অবশ্যই প্রতিশোধ নেবে, তা সে যত পরেই হোক। যেমনটা হচ্ছে ফারাক্কার বেলায়।
এ অভিজ্ঞতার পর আমরা কি আমাদের সুন্দরবনের দিকে আরেকবার চোখ ফেরাব? আমরা কি আরেকবার ভেবে দেখব, বিশ্বের সর্ববৃহত্ ম্যানগ্রোভ বন, লক্ষ বছরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না রামপালে নির্মিতব্য কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুেকন্দ্র, এ ব্যাপারে আমরা শতভাগ নিশ্চিত কিনা? এ মুহূর্তে সুন্দরবন নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, আমার দৃষ্টিতে তাকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগে পড়ে টেকনিক্যাল অন্য ভাগে পড়ে বিশ্বাস কিংবা অনুমানগত বিষয়। কোনো ভাগেই আমরা বিতর্করত পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য লক্ষ করি না। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, যা ক্ষতির মাত্রাকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নিয়ে আসবে। অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা বলছেন, এমন প্রযুক্তি ভূভারতে নেই। সামনাসামনি কথা বলেও একপক্ষ আরেক পক্ষকে বাগে আনতে পারছে না। উভয়ই বলছে, ‘জেগে ঘুমালে জাগাবে কে?’ আমি সত্যিই দ্বিধান্বিত। আবার অনুমানের ক্ষেত্রে প্রকল্পপক্ষ বলছে, শতভাগ নিশ্চয়তাসহ প্রযুক্তিগত রক্ষাকবচগুলো অনুসরণ করা হবে, আর বিরোধীরা বলছে, এটা যিনি বিশ্বাস করেন, তিনি বোকার স্বর্গে বাস করেন। ব্যক্তিগত মুনাফার আওতায় পড়ে না, এমন সরকারি প্রকল্পই তো ব্যয়সাশ্রয়ের জন্য পরিবেশগত বাধ্যবাধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখায়। তাই মুনাফার লক্ষ্যে পরিচালিত রামপাল বিদ্যুত্ প্রকল্প সুন্দরবন রক্ষার জন্য ঘুম হারাম করবে, একথা কে বিশ্বাস করবে? উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, সচিবালয় থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরের বুড়িগঙ্গা যেখানে মরতে বসেছে সবার চোখের সামনে, তখন কেমন করে বিশ্বাস করি ৩০০ কিলোমিটার দূরের সুন্দরবন আমরা বাঁচাতে সক্ষম হব? সত্যিই তো, আমরা কি বাংলাদেশে বাস করি না? নিজেদের চরিত্র কি আমাদের জানা নেই?
আমার মতো অনেকেরই হয়তো জিজ্ঞাসা, আমরা কি সুন্দরবন নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেব, তা সে যত কম মাত্রারই হোক?
লেখক: প্রাক্তন অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক সদস্য