ইভটিজিং আমাদের যাপিত জীবনের এক প্রাত্যহিক দুষ্ট ক্ষত হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের হাজারো সমস্যা ছাপিয়ে ইভটিজিং একন প্রধান সামাজিক সমস্যা। সাম্প্রতিকালে ভয়ংকর এ সমস্যার হিংস্র থাবায় ক্ষত বিক্ষত ও অপমানের দহনে জ্বলতে থাকা বহু কিশোরী-তরুণীর আত্মহননের নির্মম পথ বেছে নেয়া এবং সেই সাথে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে জাতি গড়ার কারিগর মহান শিক্ষক কিংবা মমতাময়ী মা ও অভিভাবকের মৃত্যুতে সৃষ্টি হয়েছে গভীর উদ্বেগ। সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও জীবনবোধকে গিলে খাওয়া বহুল আলোচিত এ বিষয়টিকে গিরে প্রবন্ধ বিভাগে আমাদের এবারের আয়োজন ইভটিজিং: সামাজিক ব্যাধি ও প্রতিকার।

ইভটিজিং কীঃ

ইভটিজিং শব্দটি যৌন হয়রানির একটি অমার্জিত ভাষা, যা সৃষ্টি বিবরণে পবিত্র কুরাআন ও বাইবেলে বর্ণিত প্রথম নারী “হাওয়া” ও “ইভ”কে নির্দেশ করে। আমাদের উপমহাদেশে প্রচলিত ইভটিজিং শব্দটির শাব্দিক বাংলা প্রতিশব্দ ‘নারীকে উত্ত্যক্ত করা’। তবে এর মধ্যেই ‘ইভটিজিং’ শব্দটির গুঢ়ার্থ সীমিত নয়; বরং এটি মূলত এক ধরনের ইউফেমিজম(Euphemism); অর্থাৎ উত্ত্যক্ত করার আড়ালে থাকে যৌনতার নির্লজ্জ প্রবৃত্তি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ইভটিজিংকে বলা হয় সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট। এ সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট শব্দটি জন্ম আমেরিকায়। শব্দটি প্রথম পরিচিতি পায় ১৯৭৫ সালের দিকে। In Our Time Memoir of a Revolution (1999) গ্রন্থে সুসান ব্রাউনমিলার উল্লেখ করেন, ১৯৭৫ সালে কর্নেল অ্যাস্টিভিস্টরা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট শব্দটি উদ্ভাবন করেন।

ইভটিজিং-এর ধরন ও অন্তর্ভুক্ত কাজঃ

ইভটিজিং এক ধরনের নারী নির্যাতন। স্কুল-কলেজগামী ছাত্রী, শিক্ষিকা, কর্ম পথে যাতায়াতকারী কর্মজীবী নারীসহ প্রতিটি নারীই তার চলাচলের প্রায় সর্বত্রই কোনো-না-কোনোভাবে ইভটিজিং-এর শিকার হয়ে থাকেন। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট তথা প্রাযুক্তিক অপব্যবহারের অপকৌশলসহ বাচনিক, অবাচনিক কিংবা শারীরিক উপায়ে বখাটেরা উভটিজিং করে থাকে।

বাচনিক- অশালীন মন্তব্য, শিস বাজানো, উদ্দেশ্যপূর্ণ যৌন আবেদনময়ী গান গাওয়া, হুমকি প্রদান, অবৈধ যৌন সম্পর্কের দাবি বা অনুরোধ;
অবাচনিক- লম্পট চাহনী, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, উস্কানিমূলক তালি বাজানো, যৌন অর্থবাহী ছবি বা ভিডিও দেখানো, অস্বস্তিপূর্ণ অপলক দৃষ্টি, পিছু নেয়া, মোবাইলে কুরুচিপূর্ণ ম্যাসেজ পাঠানো বা মিসকল দেওয়া, উড়ন্ত চুমুর (Flying kiss) ইঙ্গিত, চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি;
শারীরিক- ঘাড় ও কাঁধে হাত দেয়া, গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, জড়িয়ে ধরা চুমু খাওয়া, শারীরিক সম্পর্কের মতো অপ্রত্যাশিত যৌনাকাঙ্খার ব্যবহার, শরীরে ধাক্কা দেয়া, ব্ল্যাকমেইল বা চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে স্থির বা চলমান চিত্র ধারণ করা ইত্যাদি।

ইভটিজিং-এর কুপ্রভাব ও ক্ষতিঃ

ইভটিজিং নারী জীবনের সবচেয়ে বাজে ও ভয়ানক অভিজ্ঞতা। নারী জীবনে বিষাক্ত এ ইভটিজিংয়ের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ইভটিজিং নারীকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইভটিজিং নারীর অবাধ চলার স্বাধীনতায বাঁধার সৃষ্টি করে, কেড়ে নেয় তার অফুরান প্রান চাঞ্চল্য। ইভটিজিংয়ের উৎপাত শুধু ভুক্তভোগী মেয়েটির উপরই নয়; বরং তা আছড়ে পড়ে তার পুরো পরিবারের ওপর। ফলশ্রুতিতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত নারী হারিয়ে যায় হতাশার অথৈ সাগরে, যার চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে নির্মম আত্মহননের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ইভটিজিংয়ের প্রভাব নারীর প্রাণের নির্মম বলিদানেই শেষ হয় না। বরং তার বিষবাষ্পের বিষক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো সমাজ। বাধা প্রাপ্ত হয় আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। দেশের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ ইভটিজিংয়ের ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ ঘটনা ঘটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে। স্কুল বা কলেজগামী মেয়েরাই এ ক্ষেত্রে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। ফলে ইভটিজিং থেকে বাঁচতে শিক্ষাজীবন থেকে অকালে ঝরে পড়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী শিক্ষার্থী। ফলে বেড়ে যায় বাল্য বিবাহের প্রবণতা, যা আমাদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। স্কুল বা কলেজগামী নারী শিক্ষার্থীর সাথে সাথে ইভটিজিংয়ের শিকার হন কর্মজীবী নারীরাও। চলার পথে কিংবা কর্মস্থলে সহকর্মীকর টিজিংয়ের শিকার হন তারা। ক্ষেত্রবিশেষে টিজিংয়ের অতিষ্ঠ নারী বাধ্য হয় তার চাকরি ছাড়তে, যা নারীর আত্মনির্ভরশীলতার পথকে ধ্বংশ করে দেয়। অথচ বিশাল জনগোষ্ঠীর এ বাংলাদেশে নারীর আত্মকর্মসংস্থান তথা আত্মনির্ভরশীলতা অপরিহার্য। এমনিভাবে ইভটিজিং দেশের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের চরম ক্ষতি সাধন করে চলেছে।

ইভটিজিংয়ের কারণঃ

ইভটিজিং আমাদের সমাজে ভয়াবহ ক্যান্সার রোগের মতো প্রকট আকার ধারণ করেছে। গ্রাম-শহর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এর ব্যাপকতা। এর কারনে বেড়েছে নারীর আত্মহনন। আধুনিক সমাজের মরণব্যাধি এ ইভটিজিংয়ের শুধু নারী নয়, শিকার হচ্ছেন প্রতিবাদকারী শিক্ষক, মা কিংবা অভিবাবক। দেশব্যাপী ব্যাপকতর এ ইভটিজিংয়ের পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছে-

সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়
নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গির অভাব
নারীকে পন্য ও ভোগ্যবস্তু মনে করা
নারীর উগ্র পোশাক ও চলাফেরা
পর্নোর ছড়াছড়ি
স্যাটেলাইট টিভির অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত প্রদর্শন
সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অভাব
সন্তানের বেড়ে উঠা তথা সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মাতা-পিতার অসচেতনতা,
অসৎ সঙ্গ, মাদকাসক্তি, বেকারত্ব ও অশিক্ষা
লিঙ্গ বৈষম্যমূলক সামাজিক ব্যবস্থাপনা
ইভটিজিং বিরোধী স্বতন্ত্র আইন না থাকা
ইভটিজিং বিষয়ক অপরাধ বিষয়ে অজ্ঞতা
শিক্ষা ব্যবস্থায় সুস্থ চরিত্র গঠন উপযোগী যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষার কারিকুলাম বাস্তবায়ন না করা

ইভটিজিং ও আইনঃ

ইভটিজিং রোধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তবে দেশে বিদ্যমান কয়েকটি আইনে এ সম্পর্কিত ধারা উল্লেখ আছেঃ

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, ধারা ১০
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩, ধারা ১০
দন্ডবিধি ( অপরাধ সংক্রান্ত প্রধান আইন গ্রন্থ), ধারা ২৯০-২৯৪ ৩৫৪ ৫০৯
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬, ধারা ৭৬

প্রতিরোধে সাম্প্রতিক আইনী পদক্ষেপঃ

দেশব্যাপী ইভটিজিংয়ের ভয়াবহ বিস্তারে আতঙ্কিত সবাই। পাশাপাশি বিব্রত সরকার। তাই নারীর নিঃশঙ্ক ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং সহসাই সামাজিক সন্ত্রাসে পরিণত হওয়া ইভটিজিং নির্মূল ও প্রতিরোধকল্পে সাম্প্রতককালে নেয়া হয়েছে নানা আইনী পদক্ষেপ্ উদাহরণস্বরূপ –

ভ্রাম্যমান আদালতঃ ইভটিজিং বন্ধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে ভ্রাম্যমান আদালত আইনে দন্ডবিধির ৫০৯ ধারা সংযোজন করা হয়, যা ৯ নভেম্বর ২০১০ থেকে কার্যকর হয়। এ আদালতের মাধ্যমে ইভটিজারদের তাৎক্ষণিক শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেট এ ধারা প্রয়োগ করে অপরাধীকে ঘটনাস্থলে বিচার করে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড বা অর্থদন্ড কিংবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করে পারেন।

প্রতিরোধ কমিটিঃ উত্ত্যক্তকরণ বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘ইভটিজিং প্রতিরোধ কমিটি’ গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মোবাইল হেল্পলাইনঃ কোনো নারী ইভটিজিংয়ের শিকার হলে কিংবা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে মোবাইল হেল্পলাইনে সরাসরি ফোন করে অভিযোগ করতে এবং আইনি সহায়তা নিতে পারবেন। সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান দি হাঙ্গার প্রজেক্ট ও উইন্ডমিল ইনফোটেক লিমিটেড যৌথভাবে ডিসেম্বর-২০১০ থেকে এ সেবা চাল করেছে।

উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধ দিবসঃ ছাত্রীদের সর্বাঙ্গীন নিরাপত্তা বিধানের জন্য সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ার লক্ষ্যে ১৩ হুন ২০১০ প্রথমবারের মতো সারাদেশে চাত্রী উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। এর আগে ২০০৯ সালের ১৪ মে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ যুগান্তকারী এক রায়ে টিজ করাকে যৌন হয়রানি হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এ বিষয়ে সংসদে কোনো আইন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগের রায়টিকে আইনের মতো বাধ্যতামূলক হিসেবে মনে চলতে বলা হয়।

প্রতিরোধ ও করণীয়ঃ

ইভটিজিং এবং ইভটিজিংয়ের কারণে শঙ্কিত ও অনিরাপত্তার বেড়াজালে বন্দী নারীর আত্মহনন এখন দেশের অন্যতম এক সামাজিক সমস্যা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ যুগে বিশ্ববাস্তবতায় কাঙ্ক্ষিত ও সুদূরপ্রসারী উন্নয়নে প্রথমেই বন্ধ করতে হবে ইভটিজিং। এর সত্যিকারের উৎসমূল খুঁজে বের করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। পাশাপাশি প্রয়োজন আইনি কাঠামোর সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ এবং সব পর্যায়ের সমন্বিত সুসংহত উদ্যোগ। এছাড়া নারীর আত্মহনন রোধে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে নিচের করণীয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারেঃ

সন্তানের বেড়ে উঠা এবং সামাজিকীকরণে পরিবারের যথাযথ ভূমিকা পালন করা।
ধর্মীয় মূল্যবোধ, সুনীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা।
সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিরোধ জোরদার করা।
ইভটিজারদের সামাজিকভাবে বয়কট করা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া।
মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করা।
সামাজিক মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকর ভূমিকা পালন নিশ্চিত করা।
নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা।
সুস্থ বিনোদন ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা বৃদ্ধি করা।
নারীদের শালীন পোশাক পরিধানের মানসিকতা তৈরি করা এবং শালীনভাবে চলাচল করা।
সর্বত্র অশ্লীলতা, যৌন বিকার, কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও অপসংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ করা।
স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপর ভূমিকা পালন করা।
বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে আলস্য, আড্ডাবাজি ও খারাপ সংস্রব থেকে দূরে রাখা।
নারীদের সুরক্ষা ও আত্মপত্যয়ী হওয়ার সাহস জোগানো।
ইভটিজিং তথা যৌন হয়রানি রোধে পৃথক আইন পাসসহ তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং জনসমক্ষে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা করা।

পরিশেষে, ইভটিজিংয়ের আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়ে নারী ঘরে-বাইরে থাকুক নিঃশঙ্ক ও নিরাপদ এবং খুঁজে পাক তার স্বপ্নমঙ্গলময় জীবনের সন্ধান- এ প্রত্যাশায় তাই আসুন গড়ে তুলি ইভটিজিংসহ নারী নির্যাতন বিরোধী ব্যাপক প্রতিরোধ এবং প্রতিষ্ঠা করি সামাজিক মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ এক পরিচ্ছন্ন সমাজ।

সংগ্রহঃ কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স- ডিসেম্বর ২০১০।