0 Comments

একা হাঁটাচলা করতে পারে না মেয়েটি। ডান হাত ও পা দুটি অচল। শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি তাকে। খরতাপে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, কনকনে শীত উপেক্ষা করে বাবার রিকশায় চড়ে রোজ স্কুলে যায় সে। পড়ার প্রতি দুর্বার আকর্ষণ দেখে রিকশাচালক বাবা তাঁর মেয়েকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের স্কুলে আনা-নেওয়া করেন।
বাড়ি থেকে পাঁজাকোলা করে মেয়েকে রিকশায় বসান। আবার রিকশা থেকে নেমে একই কায়দায় শ্রেণীকক্ষে পৌঁছে দেন। মেয়েকে পড়াতে বাবা বছরের পর বছর নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বটুকু পালন করে চলেছেন। বাবার এই দায়িত্ব বোধে মুগ্ধ হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ এ বছর তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিভাবকের পুরস্কার দেয়।
শারীরিক অক্ষমতাকে পাশ কাটিয়ে আলোর পথে এগিয়ে চলা মেয়েটির নাম শান্তারা খাতুন (১৩)। সে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রসাইতলা গ্রামের সাইদুল ইসলামের মেয়ে। নালিতাবাড়ী পৌর শহরের আব্দুল হাকিম স্মৃতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে সে এবার জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষা দিয়েছে।
শান্তারা বলে, ‘বাবা প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টায় আমারে রিকশায় কইরা স্কুলে লইয়া আসে। ক্লাসে রাইখা শহরে রিকশা চালাইতে যায়। আবার বিকেল পৌনে চারটায় ক্লাস থেকে কোলে কইরা রিকশায় বসাইয়া বাড়িতে লইয়া যায়।’ নিরক্ষর পরিবারে আলো ছড়িয়ে বাবার পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে শান্তারা। তার সহপাঠী সাবিনা ইয়াসমীন ও মুস্তাহীনা বলে, ‘শান্তারাকে আমাদের ক্লাসের সবাই ভালোবাসে। খেলাধুলার সময় ওকে আমাদের সঙ্গে বসিয়ে রাখি।’ বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ জানান, বিদ্যালয়ে মেয়েটির উপস্থিতি শতভাগ। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাবা তাঁর মেয়েকে নিয়ে স্কুলে এসেছেন—এমন নজিরও আছে। দেখা গেছে, সেদিন হয়তো স্কুলই হয়নি।
আব্দুল হাকিম স্মৃতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার সময় দশম স্থান এবং সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার সময় সপ্তম স্থান অধিকার করে শান্তারা। তার বাবা সাইদুল ইসলাম (৫০) বলেন, ‘আমার পাঁচ সন্তানের বাকিরা সুস্থ। তারা যেভাবেই হোক, কাজ-কাম কইরা ওগর জীবন চালাইবার পারব। কিন্তু এ মেয়েডারে লইয়া আমার যত চিন্তা। ওরে লেহাপড়া করাইয়া বড় করবার চাই।’ তিনি জানান, অর্থাভাবে মেয়েটিকে বড় কোনো চিকিৎসক দেখাতে পারেননি।
গতকাল বৃহস্পতিবার রসাইতলা গ্রামে সরেজমিনে দেখা গেছে, শান্তারাদের একটিমাত্র থাকার ঘর, তা-ও ভাঙা টিনের চালা; চারদিকে বাঁশের ভাঙা বেড়া। খুপরি ঘরটিতে বাবা-মা, ভাইবোনসহ গাদাগাদি করে তাদের বাস।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যোগেন্দ্র চন্দ্র রায় বলেন, ‘শান্তারাকে যখন ওর বাবা বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নিয়ে আসেন, তখন বিশ্বাস হয়নি মেয়েটি নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসতে পারবে। কিন্তু বৃষ্টি-বাদলেও মেয়েটি সময়মতো বিদ্যালয়ে আসে। বাবা-মেয়ের স্কুলে আসা-যাওয়ার এই দৃশ্য দেখে আমরা অভিভূত। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বছর সাইদুল ইসলামকে আমরা শ্রেষ্ঠ অভিভাবক হিসেবে পুরস্কৃত করেছি।’

25_11_2011, Prothom alo, page 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts